আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম

আল-আযহারের শিক্ষা-ব্যবস্থা: আল-আযহারের সূচনা থেকে যে সকল বিষয়ে পাঠদান করা হতো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, উলুমুল কুরআন, উলুমুল হাদীস, ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ত্ব), ফিকহ (আইন), উসুলুল ফিকহ, নাহু—সরফ (ব্যকরণ), বালাগাহ (অলঙ্কার শাস্ত্র), আদাব (সাহিত্য), তারিখ (ইতিহাস), তিব (চিকিৎসা শাস্ত্র), ফালসাফা (দর্শন) এবং মানতিক (যুক্তিবিজ্ঞান) ইত্যাদি।


আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরবিন্যাস: আধুনিক আল-আযহারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত ৭ টি বিশেষ স্তরে বিন্যস্ত। নিম্নের স্তরসমূহের নাম ও সময়কাল তুলে ধরা হলো:
১. ইবতিদায়ি বা প্রাথমিক (৬ বছর)।
২. ইদাদি বা মাধ্যমিক (৩ বছর)।
৩. সানুবিয়্যাহ বা উচ্চ মাধ্যমিক (৩ বছর)।
৪. কুল্লিয়া বা অনার্স (৪ বছর)।
৫. দিরাসাত উলইয়া বা মাস্টার্স (২ বছর)।
৬. এমফিল (৩ থেকে ৫+ বছর)।
৭. পিএইচডি বা ডক্টরেট (৩ থেকে ৫+ বছর)।


আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ সমূহ: আধুনিক আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ২৪ টি অনুষদ রয়েছে । প্রতিটি অনুষদের অধীনেই রয়েছে একাধিক বিভাগ।
এভাবে আকিদা, দর্শন, ধর্মতত্ত¡, উলুমুল কুরআন, তাফসির, কিরাত, তাজবিদ, হাদিস, উসুলুল হাদিস, রিজাল, ফিকহ, ইসলামি আইন, আরবি ভাষা, বালাগাত, তর্কশাস্ত্র, তাসাওউফ, ইসলামি দাওয়াহ, তারবিয়াহ, ইতিহাস, সভ্যতা, ভূগোল, পৌরনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ব্যবসা, গণিত, ইংরেজি ভাষা, ফরাসি ভাষা, বিবিধ ভাষা ও অনুবাদ সাহিত্য, চিকিৎসা নার্সিং, দন্তচিকিৎসা, ফার্মেসী, প্রকৌশল, কৃষি ও সাংবাদিকতাসহ ধর্মীয় ও জাগতিক বিভিন্ন শাস্ত্রের সমন্বয়ে আল-আযহার হয়ে উঠে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।


বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দনীয় অনুষদসমূহ: আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ টি অনুষদ বিদেশী শিক্ষার্থীদের নিকট অধিক প্রিয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই এই ৬ টি অনুষদের কোনো একটিতে অধ্যয়ন করে থাকে। অনুষদ ৬ টি হলো:
১. ধর্মতত্ত¡ অনুষদ।
২. শরিয়া ও আইন অনুষদ।
৩. আরবি ভাষা অনুষদ।
৪. ইসলামি শিক্ষা ও আরবি অনুষদ।
৫. ইসলামি বিজ্ঞান অনুষদ।
৬. ইসলামি দাওয়া অনুষদ।


আল আযহারে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব: আল-আযহারে হিফযুল কুরআনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ১২ বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ ৩০ পারা আল-কুরআন হিফয করতে হয়। এরপর অনার্সের চার বছরের প্রতি বছর সাড়ে সাত পারা করে আবার সম্পূর্ণ আল-কুরআন রিভিশন দিতে হয়। এমনকি মাস্টার্সের ২ বছরের প্রতি বছর আবারও ৩০ পারা করে রিভিশন দিতে হয়।


তবে সরাসরি অনার্সে ভর্তি হওয়া বিদেশী শিক্ষার্থীদের উপর যাতে অতিরিক্ত চাপ না হয় তাই তাদের জন্য প্রতি বছর শুধু ১ পারা করে হিফযুল কুরআনের নেসাব রাখা হয়েছে। মিশরি ও বিদেশী উভয় প্রকারের শিক্ষার্থীদেরই প্রতি বছর লিখিত ও মৌখিক দুই ভাবে হিফযুল কুরআনের আলাদা আলাদা দুটি করে পরীক্ষা দিতে হয়।


আল আযহারে আরবি ভাষা ও শরিয়াহ শাস্ত্রসমূহের গুরুত্ব: একজন আযহারি শিক্ষার্থী যে বিষয় নিয়েই অধ্যয়ন করুক না কেন তাকে অবশ্যই নাহু, সরফ, বালাগাত, আদাব ও নুসুসসহ আরবি ভাষার বিভিন্ন শাখাশাস্ত্র এবং তাফসির, উলুমুল কুরআন, তাজবিদ, কিরাত, হাদিস ও ফিকহসহ অন্যান্য শরিয়াহ শাস্ত্রসমূহও পর্যাপ্ত অধ্যয়ন করতে হয়। প্রকৌশল, চিকিৎসা ও ব্যাবসাসহ অন্যান্য জাগতিক অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যও এ শিক্ষা বাধ্যতামূলক।


আল আযহারের প্রসারতা: মাহাদুল আযহার বা আল-আযহার ইনস্টিটিউট নামে সমগ্র মিশর জুড়ে রয়েছে আল-আযহারের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক তথা প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় স্তরসমূহের অসংখ্য শাখা। এছাড়াও রাজধানী কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ২৪ টি মৌলিক অনুষদ ও অনুষদভুক্ত বিভাগসমূহ। ২৪ টি অনুষদ বিভিন্ন শহরে পুনরাবৃত্ত হয়ে মোট অনুষদ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ টি।


তবে কেন্দ্রীয় কার্যক্রম রাজধানী কায়রো থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই সাথে আযহারের মিশরি ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের আবাসন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য রয়েছে মাশিখাতুল আযহার, মারকাযুত তাতবির লিতালিমিত তুল্লাবিল ওয়াফিদিন ওয়াল আযানিব, মাজমাউল বুহুসিল ইসলামিয়্যা, মদিনাতুল বুয়ুস ও আল-ইসকানুত তুল্লাবিয়্যুসহ বহু বড় বড় কম্প্লেক্স।

এছাড়াও মিশরের বাইরে বহু দেশে রয়েছে অসংখ্য আল-আযহার ইনস্টিটিউট। এসকল প্রতিষ্ঠান আল-আযহারের অধীনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্থানীয় আযহারিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।


আল আযহার ও চার মাযহাব : আবহমান কাল থেকেই আল-আযহার আহলুস সুন্নাহর প্রসিদ্ধ চারও ফিকহী মাযহাবের উপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। হানাফি, মালেকি, হাম্বালি ও শাফেয়ি চারও মাযহাবের পাঠদান যেমন আযহারের মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে তেমনিভাবে আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতেও গুরুত্বের সাথে বিদ্যমান রয়েছে চারও মাযহাবের গ্রন্থাদি। লা-মাযহাবিয়্যাত বা সালাফি মতাদর্শকে আযহার সব সময়ই প্রত্যাখ্যান করে আসছে।


একজন শিক্ষার্থী আল-আযহারে অধ্যয়ন শুরুর পূর্বেই তাকে নিজের মাযহাব স্পষ্ট উল্লেখ করতে হয়। যেহেতু মিশরের মুসলিমগণ ঢালাওভাবে সকলে নিদির্ষ্ট এক মাযহাবের অনুসারী নন বরং তাদের মধ্যে চারও মাযহাবের অনুসারীই বিদ্যমান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিদেশী শিক্ষার্থীরাও অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের অনুসারী হয়ে থাকে তাই সাধারণত প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় স্তরসমূহে প্রতি মাযহাবের শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীকক্ষে নির্ধারিত মাযহাবের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে ফিকহের পাঠদান করা হয়। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়েও রয়েছে মাযহাব ভিত্তিক ফিকহের দরস।


বর্তমান আল আযহারের কতিপয় প্রসিদ্ধ আলেম :
১. আহমাদ আত-তাইয়্যিব: তিনি আল-আযহারের বর্তমান শাইখুল আযহার বা গ্র্যান্ড শাইখ। তাকে ‘আল-ইমামুল আকবর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
২. মুহাম্মাদ আল-মিহরাসাবি: তিনি আল-আযহারের প্রাক্তন প্রধান। গত ২০২২ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে অবসর গ্রহণ করেন।
৩. ইবরাহিম হুদহুদ: তিনিও আল-আযহারের প্রাক্তন প্রধান। বিভিন্ন শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য সর্ব মহলে প্রশংসনীয়।
৪. প্রফেসর ড. আহমাদ ওমর হাশিম: তিনি আযহারের হাদিস বিভাগের শিক্ষক। তাকে বর্তমান যুগের ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস’ বলা হয়। তার লক্ষাধিক হাদিস মুখস্থ রয়েছে।
৫. প্রফেসর ড. আহমাদ মাবাদ আব্দুল কারিম: তিনি শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারী। হাদিস বিভাগের ডক্টর। হাদিস শাস্ত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
৬. প্রফেসর ড. মাহমুদ আব্দুর রহমান: একজন ফিকহের শিক্ষক হওয়া সত্তে ও তার হাদিসের নয়টি গ্রন্থ মুখস্থ। গ্রন্থগুলো যথাক্রমে- বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনু মাজা, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, দারেমি ও মুসনাদ আহমাদ । তিনি মালেকি মাযহাবের অনুসারী।


আল আযহারের আকিদা :
আকিদার ক্ষেত্রে আল-আযহার ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ এর অন্তর্ভুক্ত। আহলুস সুন্নাহর নিকট আকিদার প্রসিদ্ধ দুই মাযহাব তথা আশআরি ও মাতুরুদি আকিদাই আল-আযহারের আকিদা।


আযহারি আলেমগণ আহলুস সুন্নাহর চার মাযহাব তথা হানাফি, মালেকি, হাম্বালি ও শাফেয়ি মাযহাবের কোন একটিরই অনুসরণ করে থাকেন। সেই সাথে উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ ‘দারুল উলূম দেওবন্দের’ মতো আযহারও তাসাউফের বিভিন্ন সহিহ তরিকার প্রতি বিশ্বাসী।


© 2025 বাবরি ওয়ালা. এই ওয়েবসাইটটির স্বত্ত্বাধিকার.